Description
আমাদের বাড়ির দাওয়ায় বসে আমি রেলগাড়ি দেখতাম। খেলনা রেলগাড়ির মতো ছোট, দূরে মাঠ চিরে হু হু করে ছুটে যায় সেই রেলগাড়ি। ঝকঝকে দুপুর, ঝকঝকে নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, দু-চারটে মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ, বাবলাগাছ আর বট-পাকুড়ের মধ্যে দিয়ে মৃদু বাঁক নিয়ে চলে যায় সেই রেলগাড়ি।
আমাদের বাড়িটা ছিল গ্রামের এক প্রান্তে। ঠাকুরদা যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে এসে, আমাদের জন্মের আগেই, ঐ বাড়িটা করেছিলেন। খান চারেক করুগেট টিনের বড় বড় ঘর, একটা খড়ের দোচালা রান্নাঘর, গোয়াল, ঢেঁকশাল। রান্নাঘরের পিছনেই একটা ডোবা। ডোবায় ছিল মশা আর জিয়ল মাগুর-চ্যাং। ছোট ছোট মাটির সরার মতো দুড়োর বাচ্চা জল থেকে ডাঙায় উঠে আসত। সেখানেই গ্রামের শেষ, তারপর মাঠ- ফাঁকা, সবুজ মাঠ। একদিন, আমাদের বাড়ি আর রেলপথের মধ্যে স্যাকরা কাকাদের দোচালা বাড়ি উঠে আমার দিগন্ত খাটো করে দিল। রেলগাড়ি দেখার জন্য তখন ঘরের বারান্দা ছেড়ে স্যাকরা কাকাদের বাড়ি পেরিয়ে মাঠে যেতে হত। কিন্তু ততদিনে আমাদের পেয়ারাগাছটি বেশ শক্ত হয়ে উঠেছে, আমার ভার বইবার ক্ষমতা হয়েছে তার। আমি ঐ গাছের যতখানি ওঠা যায়, উঠে, গলা বাড়িয়ে থাকতাম চারটের ট্রেনের দিকে। আমার কাছে ব্যাপারটা ছিল এক সংগ্রামের মতো – কচি গাছের ডাল ভেঙে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল একদিকে, অন্যদিকে ছিল চারটের ট্রেনের সম্মোহন। আমাদের বাড়ির বাঁ-পাশ দিয়ে গ্রামের প্রধান পথ একটু গিয়েই দুভাগে ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে হাজারিতলা ছুঁয়ে সোজা গ্রামের মধ্যে, সেখানে বর্ণহিন্দুদের বর্ধিষ্ণু পাড়া – উঁচু প্রাচীর ঘেরা – জমিদার, জোতদার, কায়েত, বদ্যি, বামুনদের বাড়ি। অন্য পথটা আমাদেরই সবজিক্ষেতের পা ছুঁয়ে, ডোবার পাশ দিয়ে চলে গেছে কলুপাড়া, জেলেপাড়ার দিকে।