Nastik Panditer Vita

বুক রিভিউ : নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা

লিখলেন শাশ্বত গাঙ্গুলী


পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
লেখকঃ সন্মাত্রানন্দ


সাম্প্রতিককালে বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন জাগানো উপন্যাস “নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা”। তাই নিয়ে অনেক রিভিউ, অনেক পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখা হয়েছে, সম্ভবত অধিকাংশেই ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছেন বইখানাও। আমার হাতে আসতে এবং পড়ে ফেলতে একটু দেরিই হল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কয়েক লাইন ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ সম্পর্কে না লিখলে মন ঠিক শান্ত হচ্ছিল না। একে পাঠ প্রতিক্রিয়া অপেক্ষা ব্যক্তিগত প্রলাপ হিসেবে ভাবাই বোধহয় তাই শ্রেয়।
‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ কাহিনীর বিষয়বস্তু একাদশ শতকে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবন। সেই জীবন ধরতে গিয়ে লেখক তিনটি সময়ের ধারাকে বেছেছেন – একাদশ শতক, ত্রয়োদশ শতক, এবং বর্তমান কাল। কিন্তু সময় যেন অন্তঃসলিলা নদীর বহমান ফল্গুধারার মতো। আমাদের নিকট যা গোদা গোদা সময়ের আলাদা ধারা তাই যেন উপন্যাসটিতে একে অপরের সঙ্গে কখনো মিশে গেছে, কখনো বিচ্ছিন্ন হয়েছে – এক বৃহৎ চক্রাকার আবর্তে অতীত, ভবিষ্যৎ বর্তমান সকলেই একে অপরকে প্রভাবিত প্রসারিত করে চলেছে।

Nastik Panditer Vita
Nastik Panditer Vita written by Sanmatrananda

বিভিন্ন কালের মধ্যে এইরূপ সংশ্লেষ উপলব্ধ করবার জন্য লেখক নানা ‘খেলা’র সাহায্য নিয়েছেন। স্বপ্ন, দেহাতীত অভিজ্ঞতা ইত্যাদি প্রচলিত উপায়ের পাশাপাশি কাহিনীর ন্যারেটরকে নিয়ে যাচ্ছেটাই খেলা করেছেন। অবাক বিস্ময়ে আমরা তাই দেখি কাহিনীকার শাওন বসু হতাশ হয়ে সাউথ পার্ক স্ট্রীট সেমেটারিতে বসে থাকলে স্যার উইলিয়াম জোন্সের ভূত এসে তাঁকে পুনরায় উজ্জীবিত করে যান লিখতে, শাওন বসু লিখতে যখন শুরু করেন তখন তা প্রথম অধ্যায়ে আমরা যে লাইনগুলো পড়েছিলাম হুবহু তাই।

অবশ্য কাহিনীকারকে নিয়ে এরকম খেলা নতুন নয়। বহু লেখকই পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে খেলা করেন, তাকে শান্তিতে বসতে দেন না। গত বছর ইতালীয় লেখক ক্যালভিনোর সুবিখ্যাত বই “ইফ অন আ উইন্টার্স নাইট আ ট্র্যাভেলার” পড়লুম, সেইখানে দেখা যায় পাঠক একখানা যেন সাসপেন্স বই শুরু করছেন, কিন্তু প্রথম অধ্যায়খানা শেষ করামাত্র দেখা যায় যে পাঠক আদতে একখানা মিসপ্রিন্টের বই কিনেছেন, দ্বিতীয় অধ্যায়খানা প্রথম অধ্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাকি বইখানা এরকম নানা কাহিনীর সূত্রপাত এবং আসল কাহিনীটি খুঁজতে গিয়ে পাঠক লুডমিলা নামে এক রহস্যময়ী পাঠিকার সঙ্গে বইয়ের গোলকধাঁধার মধ্যে জড়িয়ে পড়েন ক্রমশ। আসল কাহিনী বলে হয় কি কিছু? ফরাসি লেখক রেমণ্ড কিনু (Queneau) “এক্সেরসাইজেস ইন স্টাইল” বলে একখানা বই লিখেছিলেন, তাতে নিরানব্বই উপায়ে নিরানব্বইখানা দৃষ্টিভঙ্গিতে একটাই ঘটনা ব্যাখ্যা করে গেছেন। লেখক যে দৃষ্টিভঙ্গি নির্বাচন করছেন, তাই কি চূড়ান্ত? পাঠকের উপলব্ধি, তার ইচ্ছা কি তদপেক্ষা কিছুমাত্র কম? রোলাঁ বার্থ সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন, অথর ইজ ডেড, লেখক মৃত। আমাদের কাহিনীকার শাওন বসু অবশ্য দিব্যি জীবিত, একুশ শতকের রাজনৈতিক ব্যক্তিজীবনে জড়িয়ে বিভ্রান্ত, অনিশ্চিত; “আমি, আপনি কিংবা একা অন্য কেউ…” – বলেই গেছেন লেখক।

আমি আপনি বা অন্য কেউ হতেই পারি। কদিন আগে শিমলা গেছিলুম। সেইখানে গাড়ি চেপে এবং তারপরে বরফের জন্য পদব্রজে হাটু বলে একটা শৃঙ্গের শীর্ষে উঠে দূরে মেঘাছন্ন পাহাড় উপত্যকার পিছনে রৌদ্রকরোজ্জ্বল হিমালয় দেখছিলুম, দেখতে দেখতে এইসবই মনে হচ্ছিল। হয়তো যে পথ, যে গিরিখাত উপত্যকা দেখছি আধোছায়ামাখা রহস্যঘন বিকেলে তারই কোন পথে হেঁটে তিব্বত গেছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। শেষ বিকেলের মলিন অন্ধকারে দূরে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন, হাতের মুঠো শক্ত করে ভেবেছিলেন আরও বহু পথ যাত্রা বাকি এখনো। ভেবে কেমনতর অদ্ভুত রোমাঞ্চ হচ্ছিল।

লেখায় ফের যাক। সমগ্র উপন্যাসটির অন্যতম আকর্ষণ তার মনোগ্রাহী ভাষা। ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল, আজকের বাংরাজেন্দি মার্কা মিশ্র ভাষার দাপটে এরকম ভাষা দেখলে আমার অন্তত ভারী ভালো লাগে। লেখকের লেখনী অত্যন্ত বলিষ্ঠ, তবে নানা অলৌকিক ঘটনার দাপট কারোর কারোর ক্ষেত্রে হয়তো খানিক বিরূপ ভাব সৃষ্টি করতে পারে – যে ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে লেখায় এত অলৌকিক মন্ত্রতন্ত্রের দাপট কেন? আমার তা মনে হয়নি, বরং মনে হয়েছে লেখক যে প্রেক্ষিতে তাঁর কাহিনীটি বিস্তার করতে চেয়েছেন, তার সঙ্গে তাঁর পন্থাটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঐতিহাসিক লেখা হলেই তাকে কাঠকাঠ যুক্তিবাদ মেনে চলতে হবে এরকম তো কোন কথা নেই। একমাত্র যে বিষয়টি আমার একটু সমস্যাজনক লেগেছে, তা এই যে লেখক যেন তাঁর কাহিনীর নারীচরিত্রকে বারবার হয় মা, নয় কন্যা, নয় স্ত্রী – এই কল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন।

যাহোক সেসব রইল। শেষবিচারে বলতে গেলে বলতে হয় যে আমার মতে নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা একটি অত্যন্ত সার্থক উপন্যাস- প্রাঞ্জল ভাষা, সাহিত্যগুণ, চিত্তাকর্ষক বিষয়বস্তু সব মিলিয়ে যা ক্রমে একুশ শতকের বাংলা সাহিত্যে একটি ক্ল্যাসিক হয়ে উঠবার দাবি রাখে।

নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
লেখকঃ সন্মাত্রানন্দ
প্রকাশকঃ ধানসিড়ি
দামঃ সাড়ে চারশো টাকা

Related Posts